মুসকান খান গেরুয়া উত্তরীয় পরা তরুণদের বিরুদ্ধে পাল্টা লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন।
হিজাব নিয়ে ক্রমবর্ধমান তীব্র বিতর্কের মাঝে নিজের অজান্তেই ভারতীয় মুসলিম তরুণীদের’ প্রতিরোধের প্রতীক ‘হয়ে উঠছেন মুসকান খান। ভাইরাল একটি ভিডিওতে ১৯ বছর বয়সী এই ছাত্রীর কলেজে প্রবেশ করার সময় একদল তরুণকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। হিন্দুত্ববাদ এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সংশ্লিষ্ট রঙ’গেরুয়া ‘ শাল পরা যুবকরা ওই ছাত্রীকে ঘিরে’জয় শ্রী রাম’বা ‘ভগবান রামের জয়’স্লোগান দিতে থাকেন।
মুসকান খান সেই সময় কালো দীর্ঘ গাউনের সঙ্গে হিজাব এবং মাস্ক পরে ছিলেন; গেরুয়া শাল পরা লোকজন অনবরত হেনস্তা করতে থাকায় ওই ছাত্রী দাঁড়িয়ে যান এবং পাল্টা ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে সেখান থেকে দ্রুত ভেতরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
কর্ণাটকের মান্দিয়া শহরে বসবাস করেন মুসকান খান। এখানেই ভিডিওটি ক্যামেরাবন্দি হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি যা চাই, তা হলো আমার অধিকার এবং শিক্ষা। তারা যা পরেন তাতে আমার কোনও সমস্যা নেই। কলেজে শিক্ষার্থীরা গেরুয়া উত্তরীয় অথবা পাগড়ি পরতে পারেন, যেমন আমি হিজাব পরেছিলাম।’
ভারতে প্রত্যেকদিন মুসকান খানের মতো লাখ লাখ মুসলিম নারী হিজাব এবং বোরকা পরেন। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে তাদের এই পোশাক বিতর্কে রূপ নিয়েছে। আর এই বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে গত মাসে কর্ণাটকের উদুপি জেলার একটি প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে হিজাব নিষিদ্ধ করার পর।
এই কলেজের ছয় ছাত্রী হিজাব পরার অনুমতির দাবিতে তখন থেকে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে হিজাব পরতে পারবেন, কিন্তু ক্লাসরুমে নয়।’
৩০-৪০ জন তরুণ তার দিকে এগিয়ে আসেন এবং ‘জয় শ্রী রাম’ বলে চিৎকার করেন
অন্যান্য স্কুলেও একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার পর এই বিতর্কের ডালপালা ছড়াতে থাকে; হিজাব নিষিদ্ধের সমর্থনে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো আন্দোলন শুরু করায় বিষয়টি সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়।
কিছু কিছু এলাকায় প্রতিবাদ সহিংস হয়ে ওঠায় কর্ণাটকের সরকার হাই স্কুল ও কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে এবং বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বৃহস্পতিবার কর্ণাটকের হাই কোর্টের তিন সদস্যের বিচারিক বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে, হিন্দু শিক্ষার্থীরা গেরুয়া উত্তরীয় পরে রাজ্যের কলেজ ও হাই স্কুল ক্যাম্পাসগুলো মেরুকরণ করছে বলে মনে হচ্ছে।
মান্দিয়ার স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কন্যা মুসকান খান। তার সঙ্গে যা ঘটেছে সেই বিষয়ে অভিযোগ করে তিনি বলেছেন, ‘পরিস্থিতিটি বহিরাগতদের সাজানো ছিল। যাদের বেশিরভাগই পুরুষ এবং তারা শিক্ষার্থী কিংবা তার সহপাঠীও নন।’
তিনি বলেন, ‘আমি ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য কলেজে পৌঁছাই এবং দেখতে পাই, সেখানে অনেক তরুণ গেরুয়া উত্তরীয় পরে আছেন। তারা আমার পথ আটকে দেন এবং বলেন, আমি কলেজ চত্বরে প্রবেশ করতে পারবো না।’
মুসকান কলেজের ফটকে পৌঁছানোর পর তিন অথবা চারজন শিক্ষার্থীকে দেখতে পান; যারা বোরকা পরেছেন এবং তাদেরকে গেরুয়া উত্তরীয় পরা যুবকরা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
‘তারা তরুণীদের হিজাব ধরে টানা-হেঁচড়া করছেন এবং ‘জয় শ্রী রাম’ বলে চিৎকার করছেন। তারা আমাকে হিজাব খুলে ফেলতে বলেন এবং হিজাব খুললেই তারা কেবলমাত্র আমাকে কলেজের ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেবেন বলে জানান। তারা আমাকে হুমকিও দেন।’
মুসকান খান গেরুয়া উত্তরীয় পরা তরুণদের বিরুদ্ধে পাল্টা লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন। কলেজ চত্বরে নিজের স্কুটার নিয়ে ঢুকে পড়েন তিনি এবং শ্রেণিকক্ষের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। তিনি বলেন, এ সময় ৩০-৪০ জন তরুণ তার দিকে এগিয়ে আসেন এবং ‘জয় শ্রী রাম’ বলে চিৎকার করেন।
তিনি বলেন, ‘‘তারা আবারও আমাকে বলেন, আমি যদি ভেতরে যেতে চাই, তাহলে হিজাব খুলে ফেলতে হবে। হ্যাঁ, আমি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করি। আমি যখন ভয় পেয়ে যাই, তখন আল্লাহকে স্মরণ করি আর এটা আমাকে শক্তি দেয়।’’
এমন পরিস্থিতিতে কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা এগিয়ে আসেন এবং তাকে শ্রেণিকক্ষের ভেতরে নিয়ে যান। মুসকান খান বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি যে প্রশংসা পেয়েছেন, তা দেখে তিনি অনেক খুশি। ‘তারা আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসা দিচ্ছেন। এটা আমাকে অনেক শক্তি দেয়। আমি তাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই।’
মুসকান এটাও পরিষ্কার করেছেন যে, তিনি হিন্দু এবং মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য করছেন না। মান্দিয়ার এই তরুণী বলেন, ‘আমি হিজাব পরার কারণে এই তরুণরা আমাকে শিক্ষার অনুমতি দিচ্ছে না। যে কারণে আমি নিজের অধিকারের জন্য দাঁড়িয়েছি।’
Leave a Reply