নিজস্ব প্রতিবেদক,
সিএনজি অটোরিক্সার যাত্রীরা হঠাৎ ছুরি হাতে। বলছেন আওয়াজ করলে ছুরি চালিয়ে দিবেন। তারপর হাত-মুখ বেঁধে ফেলা হলো। মেরিনড্রাইভ ধরে ইনানী, পাটুয়ারকে ও কক্সবাজার শহর ঘুরিয়ে আবারো নেয়া হলো মরিচ্যা-কোটবাজার। দীর্ঘ ৩ থেকে ৪ ঘন্টা ভ্রমনের পর মুক্তিপন আদায়ের এমন লোমহর্ষক বর্ণনা নাবিদা নিঝু নামে এক এনজিও কর্মীর।
স¤প্রতি কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়া, কোটবাজারে যাত্রী এবং চালকের বেশে ছিনতাই করে আসা একটি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্যাম্পে নিয়োজিত নারী এনজিও কর্মীদের টার্গেট করে চলছে এমন অপরাধ কর্মকান্ড। গেল এক মাসে তিনটি ঘটনার অভিযোগ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। যার ছায়া তদন্তও শুরু হয়েছে। র্যাব-পুলিশ পৃথক পৃথকভাবে এসব অভিযোগের তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।
পুলিশ ও নাবিদার ফেসবুকে দেয়া বর্ণনা থেকে জানা গেছে- গেল ১০ মার্চ বৃহস্পতিবার প্রথম অভিযোগ আসে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে। নাবিদা নিযু নামে এক এনজিও কর্মী এমন অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলেন। তার বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, কাজের প্রয়োজনে প্রায় ১ বছর যাবত আমি উখিয়াতে আছি। পরদিন শুক্রবার। উখিয়াতে সময় কাটাতে দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই বন্ধু এলিজাবেথের আব্দারে আর ‘না’ করিনি।
# দায়সারা জবাব উখিয়া থানা ওসির
# সুযোগ বুঝে বেঁধে ফেলা হয় হাত-মুখ
# চক্রের অধিকাংশ সদস্যের বয়স ১৯-২০ বছর
# মুক্তিপণের টাকা নেয়া হয় এটিএম বুথ ও বিকাশ এজেন্ট থেকে
তার সাথে ছুটি কাটাতে অফিসের পরেই কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে বের হলাম। বিকেল তখন প্রায় ৫টা । সিএনজি স্টেশনে যেতেই একটা লোকাল সিএনজি আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ভিতরে দুজন আছে দেখে আশ্বস্ত হলাম। যাত্রী তোলার আর ঝামেলা নাই, তারাতাড়িই পৌছানো যাবে।
সাধারণত লোকাল সিএনজি গুলো মেরিন ড্রাইভ ধরে যায় না। তারা সরাসরি রামু হয়ে চলে যায়। কিন্তু এই সিএনজি হঠাৎ মেরিন ড্রাইভের দিকে যাওয়া শুরু করল। কিছুটা খটকা লাগলেও ভাবলাম হয়তো ট্রাফিক জ্যাম এড়ানোর জন্যই যাচ্ছে। তাই কিছু বললাম না। রেজুখাল ব্রীজের মুখে প্রায়ই একটু ট্রাফিক জ্যাম হয়, ব্রীজে একবারে দু’পাশ দিয়ে গাড়ি যেতে পারে না বলে। ব্রীজের মুখে হঠাৎ সিএনজি ইউ টার্ন নিতে চাইলে বাঁধা দিলাম। এখন ইউটার্ন নিলে আবার অনেক দূর ঘুরতে হবে। আবার সন্ধ্যাও নেমে আসছে। রেজুখাল ব্রীজ পার হওয়ার পর বিজিবি চেক পয়েন্ট। সেটাও পার হল। হিমছড়ি পার হবার পর পাশের যাত্রীর গলার আওয়াজে ঘুরে তাকাতেই বুঝলাম আমার গলায় ছুরি ধরা হয়েছে সাথে ধমকী, একটা শব্দ হলেই গলা কেটে ফেলে দিব। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরেকজন আমার মুখে কিছু একটা চেপে ধরল সজরে। মুহূর্তে চারপাশ যেন অন্ধকার হয়ে আসলো। হঠাৎ কিছুটা সময়ের জন্য ভয়, আতংকে বোধহীন হয়ে গেলাম। হাত মুখ প্রচন্ড চেপে ধরে রেখেছে। সিএনজির এক সাইডে ছিলাম। তুমুল জোড় চলছে মাঝখানে টেনে নেয়ার। প্রাণপনে নিজের জায়গায় চেপে বসে আছি। গলায় আমার নিজের ওড়না দিয়ে ঢেকে ছুরি স্পর্শ করে আছে। সিএনজি ছুটে চলছে। চিৎকার করতে গিয়ে মুখ দিয়ে গোঙ্গানির মতো শব্দ বের হচ্ছে। পাশ দিয়ে অনেক গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ আমাকে দেখতে পারছে না। কি অসহায় অবস্থা!
মুখে গামছা ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। যা আমার গলায় গিয়ে লাগছিলো। চাপের কারণে দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে মুখ ভরে যাচ্ছিলো। তাদেরকে ইঙ্গিতে বোঝাতে হয়েছে, তাদের আমি সাহায্য করবো। সিএনজি ড্রাইভারও এখানে জড়িতো ছিলো।
ওই নারী এনজিও কর্মী আরও লিখেন, এমনকি তাদের কাছে দড়িও ছিলো আমাকে বাধার জন্য। আমার কাছে পর্যাপ্ত ক্যাশ টাকা না পেয়ে ড্রাইভারের সাথে একজনের ঝগড়া লেগে গেলো। একজন চাচ্ছে আমাকে আহত করে মেরিন ড্রাইভে ফেলে যেতে আর অন্যরা চাচ্ছে আমাকে নিয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে। অত:পর তারা সিদ্ধান্ত নিলো এটিএম বুথেই যাবে। তাদের দাবি ছিলো ১ লাখ টাকার। প্রয়োজনে মুক্তিপণ দাবি করবে, এমন পরিকল্পনাও ছিলো।
তারপরের ঘটনা সংক্ষেপে, প্রায় তিন ঘন্টা এই সিএনজি আমাকে নিয়ে কলাতলী ডলফিন স্কয়ার হয়ে লিংক রোড অত:পর উখিয়ার একটু আগে হিজলিয়া পর্যন্ত ঘুরেছে। বিভিন্ন বুথ থেকে আমার ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং বিকাশ মিলিয়ে প্রায় ৭০ হাজার টাকা তারা তুলতে পেরেছে। এর মাঝে আমাকে নিয়ে ইনানী বিচের দিকেও যেতে চেয়েছে, ঐদিকে নাকি এটিএম বুথ আছে। আমার জানামতে হিমছড়ি থেকে ইনানী যেতে কোনো এটিএম বুথ নাই। হয়তো ওদের অন্য কোন পরিকল্পনা ছিলো। অনবরত কথা বলে, অনুনয়-বিনয় করে ওদের শহরের দিকে নিতে রাজি করাই। শেষ পযন্ত রাত সাড়ে আটটার দিকে মুক্তি পাই। তারাই হিজলিয়া থেকে আরেক সিএনজিতে উঠিয়ে দেয় কক্সবাজারে যাওয়ার জন্য। এই তিন ঘন্টা এতটা সহজ ছিলো না। একটা সময় মনে হয়েছিলো, আমার হয়তো আর পরিবার, বন্ধু-বান্ধব কারও সাথে দেখা হবে না। আম্মু সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছিলো। ছিনতাইকারীরা কেটে দিচ্ছিলো। ফোনের ওপাশেই আম্মু। কিন্তু কল্পনাও করতে পারছে না, আমি তখন কোন অবস্থায় আছি। ফোন না ধরাতে এলিজাবেথও কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলো এবং ৯৯৯ এ কল ও করতে যাচ্ছিল।
ক্যাম্প নিয়োজিত ফেন্ডশীপ এনজিওর প্রজেক্ট ম্যানেজার পারসা সানজানা নামে একজন উখিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। যেখানে তিনি লিখেছেন, গেল ২৯ মার্চ কোটবাজার থেকে লিংকরোড হয়ে আসবে কক্সবাজারে। স্টেশন থেকে একটি সিএনজি অটোরিক্সায় উঠেন। যেখানে আগে থেকে সামনে ও পেছনে দুইজন করে চারজন বসা ছিল। তিনি উঠার পর মরিচ্যা বিজিবি চেকপোস্ট পার হওয়ার পর হঠাৎ পেছনে আরেকটি সিএনজিতে আসা ৫ জনসহ ৯ যুবক এই নারীর মূখ চেপে ধরে হাত-মূখ বেঁধে ফেলে। উল্টো দিকে গাড়ী ঘুরিয়ে মরিচ্যার একটি ব্যাংকের এটিএম বুথের থেকে প্রথমে ১০ হাজার তোলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কোটবাজার থেকে অপর একটি বুথ থেকে ৫ হাজার টাকা উত্তোলন করে। পরবর্তীতে ওই এনজিও কর্মীর পিতা থেকে মুক্তিপণ হিসেবে বিকাশে ২৫ হাজার টাকা নেয়। পরবর্তীতে চারদিকে ঘুরিয়ে উখিয়ার হিজলিয়া নামক স্থানে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।
অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জুর মোর্শেদ দায় সাড়া জবাব দিয়েছেন প্রতিবেদকের কাছে। ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেই পরে আলাপের পরামর্শ তার।
বিষয়টিকে কেন গুরুত্ব দিচ্ছে না পুলিশ এমন প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ফোন কেটে দেন তিনি।
তবে বিষয়েগুলো নিযে ছায়া তদন্ত শুরু করার কথা জানিয়েছে র্যাব। কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর সহকারী পরিচালক এএসপি নিত্যনন্দ দাশ প্রতিবেদককে বলেন, স¤প্রতি ঘটে যাওয়া এমন দুইটি ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু হয়েছে। বেশকিছু আলামতও মিলেছে। শীঘ্রই আসামীদের সনাক্ত করা সম্ভব হবে। তারপরই গ্রেপ্তারে অভিযান।
Leave a Reply