ইমাম সাহেব এশার নামায পড়াচ্ছিলেন, প্রথম রাকাতের দ্বিতীয় সেজদা থেকে উঠার আগেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। এই বিদ্যুৎ চলে যাওয়াটাই ইমাম সাহেবের চাকরি যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।
ইমাম সাহেব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার মানে বুঝেন তো, অভাবের কথা কাউকে না পারে বলতে, না পারে সইতে। এই রকম এক পরিবারের সন্তান মাও. মুনিরুল ইসলাম। মাওলানা পড়া শেষ না করলেও সবাই তাকে মাওলানা বলেই ডাকে। কারণ, মাদরাসায় পড়তে পড়তেই বড়ো হয়েছে। মাদরাসায় জামাতে হাশ্তুম শেষ করেই তাকে চাকরির জীবনে পদার্পণ করতে হয়েছে। এছাড়া আর উপায় কী? বাড়ির একমাত্র কর্মক্ষম লোক বাবা পঙ্গু অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করছেন। আগে রিকশা চালাতেন। একদিন চাত্রদলের বিক্ষোভে ছাত্রলীগের হামলা, অতঃপর ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার মধ্যখানে পড়ে পায়ে সজোরে কিসের যেন আঘাত পড়ে। সেই থেকেই ভাঙ্গা পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে মুনিরুল ইসলাম লেখা-পড়া বাদ দিয়ে চাকরির খুঁজে লেগে যায়।
দূরে যেতে হলো না। পাশের গ্রামের পঞ্জেগানা মসজিদের ইমাম সাহেবকে বিদায় দেওয়া হচ্ছে শুনে ঐ মসজিদের সভাপতির সাথে যোগাযোগ করলো মুনিরুল ইসলাম। সভাপতি সাহেব খুশি হলেন। কারণ, ইমামের খুঁজে দূরে যেতে হলো না। চার হাজার টাকা বেতনে রেখে দিলেন মুনিরুল ইসলামকে। বেতন বলবো কী করে? সভাপতি সাহেব বেতন বললেও আমি বলতে পারি না। অন্তত পকেট খরচ বা হাদিয়া বলা যায়। মসজিদের চাকরি যারা করে, তারা বেতন পায় না। বেতন তো সরকারী চাকরি আর বিদেশী চাকরিতে মিলে।
মনিরুর ইসলাম খুশি। কারণ এই চার হাজার দিয়ে পুরো পরিবারের খরচ আঞ্জাম দেওয়া না গেলেও অন্তত করচটুকু যোগাতে পারবে। শুরু হলো মুনিরুল ইসলামের ইমামতি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আযান, নামায পড়ানো আর সকালে ফোরকানিয়া।
এভাবেই চলছে তার চাকরির জীবন। সপ্তাহ না যেতেই পাঁচ দিনের মাথায় ঝামেলা শুরু হলো। সকালে ফোরকানিয়ার এক ছাত্র টয়লেটে গিয়ে কমেডের উপরেই কাজ সেরে আসলো। ইমাম সাহেব কিন্তু এই খবর জানেন না। কারণ, তার ঐ দিকে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। ফোরকানিয়া ছুটি হলো, দুপুর পর্যন্ত ঐ দিকে যাওয়া হলো না। জুহুরের আযানের আগেই মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি সাহেব উপস্থিত। টয়লেট সারতে গিয়ে মাথা হয়ে গেলো গরম। বেটা ইমাম সাব করেটা কী? টয়লেট অপরিস্কার কেন? এভাবে চিল্লাচিল্লি করতে করতে আসতে লাগলেন ইমাম সাহেবের রুমের দিকে। ইমাম সাহেব আযান দেওয়ার জন্য বের হচ্ছিলেন রুম থেকে। দরজার সামনেই পেয়ে গেলেন ইমাম সাহেবকে। ইমাম সাহেব সেক্রেটারিকে দেখে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই সেক্রেটারির বুম ফাটানো চিৎকারে ইমাম সাহেব পড়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেলেন। সেক্রেটারি চিল্লিয়ে বলতে লাগলেন- ইমাম সাহেব! তুমি করোটা কী? অ্যাঁ! তোমার খাওয়া আর ঘুম ছাড়া আর কোন কাম নাই?
– কেন সাহেব? কী হয়েছে? কোন ভূল….
– টয়লেটের এই অবস্থা কেন? কমেডের উপরে কার সারবি তুই আর মুসল্লি এসে পরিস্কার করবে?
– কী বলেন? আমি আজ ওদিকেই যাইনি। আর….
– চুপ! মোল্লাদের হত্তর দরজা থাকে। এখন পরিস্কার করে আয়! খাবি আর ওখানে সারবি, এখানে তোর কামলা সবাই…. আরো অনেক কথা বলে গেলো। সব কথা ইমাম সাহেবের কানে গেলো বলে মনে হলো না। কারণ, সে তখন অন্য চিন্তায়। কে এসে উপরে টয়লেট সারলো, আর সমস্ত ক্ষোভ এসে পড়লো আমার উপর।
সব ভুলেই ইমাম সাহেব টয়লেট পরিস্কার করে আযান দিতে গেলো। আযান দিতে দেরি হওয়ায় আরেক বকা খেতে হলো। এভাবেই চলছে তার চাকরি জীবন। একদিন টয়লেট অপরিস্কারের জন্য বকা শনতে হয়, আরেকদিন ট্যাপে পানি নেই, মসজিদে ময়লা কেন, ঝাড়ু দিতে কষ্ট হলে ইমামের চাকরি নিলে কেন ইত্যাদি। আরো কতভাবে ইমামের দোষ খুঁজে বের করে তার ইয়ত্তা নেই। যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে না, সেও হঠাৎ মসজিদে এসে পায়ে সামান্য বালি লাগলেই ইমাম সাহেবের গুষ্টিশুদ্ধ উদ্ধার করে।
মুনিরুল ইসলাম সব শুনেও সহ্য করে যাচ্ছে। কারণ আওয়ামুননাসের গালি শোনার অভিজ্ঞতা তার জন্য নতুন। ইমামতির দায়িত্ব পালন করতে গেলে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন কথা হজম করতে হয়। হয়তো এটাই নিয়ম। ইমাম সাহেবও যে মানুষ, তাদেরও কত কাজকাম থাকে, পারিবারিক কাজেও তাদের সময় দিতে হয়, তা কি সব মুসল্লি বুঝে? যারা বুঝে তারা তো অসম্মান করছে না। এটাই এখন ইমাম সাহেবের সান্ত্বনা।
দু’মাস পরের কথা। মাগরিবের নামায পড়তে আসা মুসল্লিদের বাড়ি থেকে অযু করে আসতে হলো। কারণ, সারাদিন বিদ্যুৎ নেই। এশার নামাযের আগ মূহুর্তে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে আসলো। ইমাম সাহেব মটরের সুইচ অন করে আযান দিলেন। মুসল্লিরা অযু করে মসজিদে ঢুকে গেছে। ফরজ নামাযের প্রথম রাকাতের দ্বিতীয় সেজদা থেকে উঠার আগেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। তখনও মটরের সুইচ অন।
নামাযের পর কারো স্মরণ নেই মটরের সুইচ বন্ধ করার ব্যাপারে। এমনকি ইমাম সাহেবেরও। চলে গেলো সবাই। ফজরের নামায পড়তে এসে সভাপতি সাহেব দেখে মসজিদের পুরো আঙ্গীনা নদীর মতো হয়ে গেছে। যেন নদীর ঢল নামছে। খোঁজ নিয়ে দেখে, রাতে যাওয়ার সময় মটরের সুইচ বন্ধ করা হয়নি। চটে গেলো ইমাম সাহেবের উপর। যেন এক্ষুনি কেয়ামত নেমে আসবে। না, ইমাম সাহেবকে কিছু বললেন না। ফজর নামযের পর কমিটির সবাইকে ডাকলেন। ইমাম সাহেবকেও। ইমাম সাহেবকে মাসের টাকাগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বললেন- ইমাম সাহেব! তুমি তোমার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছো। অনেকদিন ধরে সহ্য করতেছি, আর না। এবার আপনি যেতে পারেন।
-দায়িত্ব অবহেলা, নাকি খুঁজে খুঁজে দোষ বের করে দোষী সাব্যস্ত করে বিদায় করা হচ্ছে।?
– বেশি কথা বলা ভালো নয়। সম্মানের সাথে বিদায় করতেছি। তাড়াতাড়ি চলে যান।
-আমার কিছু কথা আছে জনাব… আবার কথা! বলে তেড়ে উঠে সভাপতি। ইমাম সাহেবকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগই দিলো না। ইমাম সাহেব কাকে বোঝাবে দুঃখের কাহিনী। সে যে দোষী নয়, সবাই দোষ খুঁজে খুঁজে বের করে দোষী বানানো হচ্ছে এবং হয়েছে সবসময়। এই তো, রাতে তার স্মরণ ছিলো না মটরের সুইচ বন্ধ করতে। কিন্তু প্রায় বিশজন মতো মুসল্লি, তার মধ্যে দশ/বারোজন কমিটির লোক, তাদেরও কি স্মরণ ছিরররো না? নাকি ইমাম সাহেবকে শায়েস্তা করার জন্য এই ফন্দি? একবার ভেবে দেখুন তো, আজ মুনিরুল ইসলর
Leave a Reply