(এই লেখাটা মুফতি তাকি উসমানী সাহেব হাফি. কওমি মাদ্রাসার বর্তমান এই দুরাবস্থা দেখে, নিজের শত শত তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন। মনের গভীরে চেপে রাখা অনেক দিনের কষ্ট আর আফসোস গুলো কলমের ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তাই প্রত্যেকটা কওমি মাদ্রাসার সম্মানিত শিক্ষক মন্ডলী ও পরিচালনা কমিটির কাছে, এই লেখাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়ার আন্তরিক নিবেদন রইল। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন।)
উনি বলেন, অনেক চিন্তা ভাবনা করার পর যতোটুকু আমি বুঝতে পারলাম তা হল:
কওমি মাদ্রাসার অধঃপতনের মূল কারণ হল “আস্তে আস্তে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাটা গতানুগতিক একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে। আর এর আসল উদ্দেশ্য আমরা ভুলে গিয়েছি”। যদিও আমাদের মুখে এখনো এ কথাই শোনা যায় যে, “এই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল ইসলাম ধর্মের খেদমত করা”। তবে তিক্ত বাস্তবতা হল, এগুলো শুধু মুখেই বলা হয় অন্তরে থাকে অন্য কিছু। কেননা বাস্তবেই যদি আমাদের অন্তরে এই উদ্দেশ্য থাকত, তাহলে আমাদের সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা এটাই থাকত। আকাবির ও আসলাফদের মত সর্বদা আমাদের মাথায় ঘুরত, আমাদের কোনো কাজে আল্লাহতালা অসন্তুষ্ট হচ্ছেন কিনা?? আমাদের কাজে-কর্মে দ্বীনের কতটুকু খেদমত হচ্ছে?? আমরা আমাদের মূল উদ্দেশ্যে কতটুকু সফল হয়েছি??
বরং উল্টো আমরা আমাদের সম্পূর্ণ মনোযোগ মাদ্রাসার বাহ্যিক উন্নতিতে লাগিয়েছি, যা আমাদের আসল উদ্দেশ্য নয়। বেশিরভাগ মাদ্রাসার পরিচালকরা সর্বদা এটাই চেষ্টা করেন যে, কিভাবে আমার মাদ্রাসাটা প্রসিদ্ধতা লাভ করবে?? কিভাবে ছাত্রের সংখ্যা বাড়ানো যাবে?? কিভাবে দেশের নামকরা শিক্ষকদের এখানে জমায়েত করা যাবে?? এককথায় কিভাবে জনসাধারণের মাঝে মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির ভালোবাসা আর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে?? আর এগুলোর পিছনে আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর রাত-দিনের দৌড়ঝাঁপ দেখলে তো মনে হয়, এগুলোই আমাদের আসল উদ্দেশ্য। আবার এই উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য আমরা এমন পন্থাও অবলম্বন করি, যা একজন আলেমের জন্য কখনো সমিচীন নয়। বরং কখনো কখনো তো আমরা স্পষ্ট নাজায়েজ আর অবৈধ-পন্থা অবলম্বনে করতেও দ্বিধাবোধ করি না।
অন্যদিকে যদি কোনো মাদ্রাসা মোটামুটিভাবে এগুলো অর্জন করে ফেলে, তাহলে মনে করা হয় আসল উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেছে। অথচ আমাদের ছাত্রদের শিক্ষা, চারিত্রিক ও ধর্মীয় অবস্থা কেমন?? আমরা মুসলিম সমাজ পরিচালনা করার জন্য কেমন মানুষ তৈরি করেছি?? আমাদের চেষ্টা ও মুজাহাদার দ্বারা বাস্তবে ইসলামের কতটুকু উপকার হচ্ছে?? সেগুলোর কোন খবরই থাকে না। আর আস্তে আস্তে তো এসব বিষয়ের খোঁজখবর নেওয়া, চিন্তাভাবনা করার মানুষ ও কমে যাচ্ছে।
মোটকথা এই অধঃপতনের মূল কারন হল, “খিদমতে দ্বীন আমাদের আসল উদ্দেশ্য” এটা একবার মুখে উচ্চারণ করার পর কর্মজীবনে আমরা তা ভুলে যাই। আর এই বাহ্যিক জিনিসগুলো ঘিরেই চলতে থাকে আমাদের মেহনত-মুজাহাদা, শ্রম-সাধনা সবকিছুই। অথচ এগুলো আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং এগুলোর সাথে তো ইসলামের কোনো সম্পর্কই নেই আর থাকলেও এই শর্তে যে, আমাদের মূল উদ্দেশ্য ইসলামের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য নিয়ত শুদ্ধ রেখে এগুলোকে শুধু মাত্র মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত আফসোস ও পরিতাপের বিষয় হল,আমরা এগুলোকেই মূল উদ্দেশ্য বানিয়ে ফেলেছি।
এমনিভাবে কওমি মাদ্রাসার গৌরবময় ইতিহাসের এক উজ্জল বৈশিষ্ট্য হল, এখানের শিক্ষক ছাত্রদের পারস্পরিক সম্পর্কটা গতানুগতিক সাধারণ কোন সম্পর্ক নয় যা, শুধু মাত্র শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বরং এটা পরস্পরের মধ্যে আত্মার পবিত্র সম্পর্ক। যা শিক্ষা জীবন থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত অটুট থাকত। উস্তাদ শুধুমাত্র কিতাব পড়ানোর জন্য নিযুক্ত কোন শিক্ষক ছিল না, বরং নিজ ছাত্রদের জন্য তাঁরা ছিলেন কল্যাণকামী দরদী এক মহান পিতা। আর ছাত্রদের চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক দিক নির্দেশনা প্রদান কারী। ইলম ও আমলের ময়দানে ছাত্রদের শুভাকাঙ্ক্ষী এক অভিভাবক। সাথে সাথে তাঁরা ছাত্রদের নিজস্ব বিষয়গুলো ও দেখাশোনা করতেন। ফলে ছাত্ররা শিক্ষকদের থেকে পুঁথিগত শিক্ষা পাওয়ার সাথে সাথে চারিত্রিক শিক্ষা ও গ্রহণ করত। তাঁদের থেকে জীবন পরিচালনা করা শিখত। শিখত ধার্মিকতা, একনিষ্ঠতা, বিনয়-নম্রতা সহ উত্তম চরিত্রের আরো অনেক গুণাবলী। আর এভাবেই ছাত্ররা শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় শিক্ষকদের সাদৃশ্য হয়ে উঠত।
বিশেষ করে “দারুল উলুম দেওবন্দ” যেই মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশ্বের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এক ভিন্নরকম উচ্চতায় পৌঁছেছে তা হল, এটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় বরং আদর্শ মানুষ গড়ার এক বিশাল কারখানা। যেখানে শিক্ষার চেয়ে দীক্ষার পরিমাণই বেশি থাকে। ফলে তৈরি হয় সঠিক শুদ্ধ আকিদায় বিশ্বাসী একনিষ্ঠ একজন পাক্কা মুসলমান। যারা কথার চেয়ে বেশি নিজেদের সুন্দর আচার-ব্যবহার আর উত্তম চরিত্রের মাধ্যমেই ইসলামের প্রচার-প্রসার করে।
কিন্তু আফসোসের বিষয় হল আস্তে আস্তে এগুলো বিষয় আদিম যুগের ইতিহাসের মতো হয়ে যাচ্ছে। আর এর মূল কারণ হচ্ছে শিক্ষকরা নিজেদের মূল উদ্দেশ্য এটা কে বানিয়েছেন যে, শ্রেণিকক্ষে এমন ভাবে পড়ানো যাতে ছাত্ররা খুশি হয়ে যায। তাঁরা সব সময় ভাবতে থাকে, পড়ানোর জন্য তাঁদেরকে কেমন প্রবন্ধ বা কিতাব দেওয়া হয়েছে?? কিভাবে ছাত্রদের ওপর নিজের জ্ঞানের প্রভাব পড়বে?? কোন পদ্ধতি অবলম্বন করলে ছাত্রদের মাঝে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে?? আর এই গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে গিয়ে কোন পদ্ধতিতে পড়ালে ছাত্রদের বেশি উপকার হবে, সেটা ভুলে যায়। বরং কখনো তো তাঁরা খুঁজতে থাকে যে, কোন পদ্ধতিটা ছাত্রদের প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী হবে?? ফলে শিক্ষকগণ ছাত্রদেরকে দিক-নির্দেশনা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের প্রবৃত্তির অনুগত হয়ে যায়। আর ছাত্ররা শিক্ষকের পিছনে চলে না বরং শিক্ষকরা ছাত্রদের চাহিদার পিছনে দৌড়াতে থাকে।
কিন্তু কিভাবে পড়ালে ছাত্রদের উপকার হবে?? কী কী শেখালে ছাত্ররা ধর্ম, দেশ ও জাতির জন্য আরও উপকারী হিসেবে গড়ে উঠবে?? ছাত্রদের কী ধরনের আগ্রহ-উদ্দীপনা, চাহিদা তাদের জন্য ক্ষতিকর?? কিভাবে ক্ষতিকর জিনিস থেকে তাদের আগ্রহ দূর হবে?? শ্রেণীকক্ষের বাইরে তারা কিভাবে চলা ফেরা করছে?? এগুলো বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা, ছাত্রদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য পূরণে এগিয়ে আসার মতো লোকেরাও আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
তাই এখন সর্বপ্রথম আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ এলাকায় কওমি মাদ্রাসার মৃত্যুপ্রায় এই “প্রাণ” পুনরায় তাজা করার প্রয়োজন। কেননা এটি ছাড়া আমাদের কওমি মাদ্রাসাগুলো বেশির থেকে বেশি আক্ষরিক জ্ঞানের “কেন্দ্র” হতে পারবে। ইসলামের সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর শত্রু ইউরোপ আমেরিকার মুশরিক প্রাচ্যবিদদের মতো মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা এবং নির্দিষ্ট কিছু বিষয় পড়াশোনা করানোই আমাদের মূল উদ্দেশ্য হয়ে যাবে। আর আস্তে আস্তে একদিন আমরা দ্বীনি শিক্ষার অপরিহার্য ও আবশ্যকীয় এই বৈশিষ্ট্যগুলি হারিয়ে, অবশেষে একদিন দ্বীনহারা হয়ে পড়ব।
কওমি মাদ্রাসার এই প্রাণ যা সময়ের ঘূর্ণিপাকে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, এটাকে পুনর্জীবিত করতে সবচেয়ে বড় গুরুদায়িত্ব হল প্রত্যেকটি মাদ্রাসার শিক্ষক এবং পরিচালনা কমিটির সদস্যের উপর। তাদের উচিত হল সর্ব প্রথম তাঁরা নিজেদের আমল-আখলাকের দিকে নজর দিবে। তাঁরা দেখবে ইসলামী শিক্ষা তাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন এনেছে কি না?? আল্লাহর ভয় আর আখেরাতের চিন্তায় তাঁদের অন্তর কেঁপে ওঠে কি না?? রবের সাথে তাঁদের নৈকট্য বৃদ্ধি পেয়েছে কি না?? ইবাদতের প্রতি তাঁদের আগ্রহ কতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে?? আমলের যেই ফজিলত গুলো দিনরাত তাঁরা অন্যকে শোনাচ্ছে, নিজেরা তার উপর কতটুকু আমল করছে?? আল্লাহর রাস্তায় দান সদকা করার জন্য অন্যদেরকে কুরআন হাদীস শুনিয়ে যেই উৎসাহ উদ্দিপনা দেওয়া হয়, নিজেরা তাতে কতটুকু অংশ গ্রহণ করেছে?? ইসলামের জন্য জান ও মালের কুরবানী দেওয়ার জন্য কতটুকু প্রস্তুতি নিয়েছে?? সমাজের এই অধঃপতনে তাঁরা অস্থির হয়ে ছটফট করছে কি না?? সুন্দর সুশীল সমাজ বিনির্মাণের চিন্তা-চেতনা তাদের মন-মস্তিস্কে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে?? যদি এগুলো বিষয় নিয়ে আমরা চিন্তা করি,বাস্তবতা আর সততার সাথে নিজেদের মাঝে এগুলোর উত্তর খুঁজি তাহলে লজ্জায় শরমে মাথা নিচু করে আফসোস আর অনুতাপ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
তাই এখন সময়ের দাবি, এই আফসোস আর অনুতাপ থেকে শিক্ষা নিয়ে আর লজ্জা-শরম কে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ সুন্দর করা। তবে এটা সাময়িক হলে, তাতে কোন উপকার হবে না। বরং সর্বদা এটা মনেপ্রাণে ধারণ করে নিতে হবে,আর নিজেদের ভবিষ্যৎকে চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলতে হবে। তাহলেই হয়ত আবার ফিরে যেতে পারি আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেই সোনালী অতীতে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে দ্বীনের জন্য কবুল করুন।
Leave a Reply