পদ্ধতিগত (নির্বাচনী) গণতন্ত্রের চর্চা: ইসলামী সরকার বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ও বাস্তবতা!!

নিউজ ডেস্ক:

পদ্ধতিগত (নির্বাচনী) গণতন্ত্রের চর্চা: ইসলামী সরকার বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ও বাস্তবতা!!- আহমদ আলী। [গণতন্ত্র: ইসলামী দৃষ্টিকোণ নতুন সংস্করণ (প্রকাশিতব্য) বই থেকে] গণতন্ত্র বিরুদ্ধে এক দল আলিমের একটি বড়ো আপত্তি হলো- প্রচলিত গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলামী সরকার গঠন করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কেননা, গণতান্ত্রিক নির্বাচনব্যবস্থা বলতে গেলে কার্যত টাকার খেলা, প্রভাব-প্রতিপত্তির খেলা, ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের খেলা, ব্যালট বাক্সে জাল ভোট ভর্তির খেলা, এসব খেলা কোনো ইসলামী আদর্শবাদী লোকেরা খেলতে পারে না। অতএব, তাদের পক্ষে ব্যাপকভাবে বিজয়ী হওয়া এবং দলগতভাবে জয় লাভ করা, অন্তত সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তদুপরি গণতন্ত্রে যেহেতু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতবাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয় এবং সেখানে তাদেরকে তাদের নিজস্ব মত, চিন্তা ও মতাদর্শ লালন ও প্রচারের অধিকারও মেনে নিতে হয়, তাই গণতন্ত্রের মাধ্যমে কোনোভাবেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এ আপত্তির মধ্যে দুটি প্রসঙ্গ রয়েছে এক. গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলামী সরকার গঠন এবং ইসলামপন্থীদের পক্ষে বিজয়লাভ ও ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। দুই. গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। প্রথম প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হলো- আমরা মনে করি, এ কথাটি যদিও কোনো কোনো দেশে গণতন্ত্র চর্চার অবস্থার নিরিখে সঠিক মনে হয়; কিন্তু গণতন্ত্রের মূল ধারণা, আদর্শ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতে তা যুক্তিযুক্ত নয়। আমরা মুসলিম বিশ্বের এমন অনেক দেশ (যেমন: সুদান, আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ) সম্পর্কে জানি, যেখানে গণতন্ত্র সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারলে অল্প সময়ের মধ্যেই ইসলামপন্থার অনুসারীরাই সরকার গঠন করবেন। তাই এসব দেশে যাতে ইসলামপন্থার অনুসারীরা সরকার গঠন করতে না পারেন, এ কারণে মুসলিমবিদ্বেষী বিশ্বমোড়লরা সেসব দেশে গণতন্ত্রের চর্চাকে নানা উপায়ে বাধাগ্রস্ত করে চলছে। মূল কথা হলো- বর্তমান গণতান্ত্রিক নির্বাচনব্যবস্থা ইসলামী সরকার গঠনের জন্য বড়ো বাধা নয়। ইসলামী সরকার গঠনের জন্য সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন হলো, ইসলামী সরকার গঠনের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা। আর এজন্য ইসলামপন্থিদের জনমত সৃষ্টির যুগোপযোগী মাধ্যমগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ইসলামী শাসনব্যবস্থার পক্ষে নিয়ে আসতে হবে। এতদুদ্দেশ্যে দাওয়াহ ও তারবিয়াহ কার্যক্রম বাড়াতে হবে, শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে এবং শিক্ষা ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটাতে হবে।বলার অপেক্ষা রাখে না, যে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ইসলামী সরকার প্রত্যাশা করবে, তাতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনব্যবস্থা_ যদি তা সুষ্ঠুভাবে বিকশিত করা যায়_ ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার করার পথকে বাধাগ্রস্ত তো করবেই না; বরং অধিকতর প্রশস্ত ও সুগম করে দেবে। জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে যেকোনোভাবে জোরজবরদস্তিমূলক ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে ইসলামও সমর্থন করে না। আর এভাবে কোনোক্রমে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে তা টিকিয়ে রাখা একেবারেই সম্ভব নয়।

অনেকেই ‘গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলামী সরকার আদৌ কায়েম করা সম্ভব নয়’- এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিককালের মিসর ও আলজেরিয়াকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। আলজেরিয়ায় ইসলামপন্থার অনুসারীগণ নির্বাচনে জিতেও ক্ষমতায় যেতে পারেনি এবং মিসরে ক্ষমতায় গিয়েও টিকে থাকতে পারেনি। আমরা মনে করি, এটা গণতন্ত্রের ত্রæটি নয়। সেই দেশদুটিতে কিছু সময়ের জন্য হলেও গণতন্ত্রের সুবাতাস প্রবাহিত হয়েছিল বলেই তারা নির্বাচনে জিতেছিল এবং ক্ষমতায়ও যেতে পেরেছিল। আর তাদের যা ব্যর্থতা (অর্থাৎ ক্ষমতায় যেতে না পারা কিংবা ক্ষমতায় টিকতে না পারা) তার মূল কারণ ছিল বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ষড়যন্ত্র ও অপরাজনীতি এবং সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষ। বিশ্লেষকদের মতে, মিসরে মুরসীর পতনের পেছনে মূল কারিগর ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল; সৌদি আরবও গোপনে নানাভাবে ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিল। তারা মিসরে ইখওয়ানের উত্থানকে নিজেদের অস্তিত্ব ও মধ্যপ্রাচ্যে খবরদারির জন্য হুমকি মনে করেছিল। উল্লেখ্য, গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় গেলেই এবং সরকার গঠন করলেই যে পরিপূর্ণ ইসলাম কায়েম হয়ে যাবে তা নয়। কারণ, ইসলাম একটি বিপ্লবের নাম; আমূল পরিবর্তনের নাম; ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সকল দিক ও বিভাগের পরিবর্তনের নাম; দু/চারটি বিধান কার্যকর করার নাম ইসলাম প্রতিষ্ঠা নয়; বরং ইসলাম প্রতিষ্ঠার অর্থ হলো_ ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাস থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে ইসলামী নীতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ও প্রতিষ্ঠা। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতন্ত্রের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ইসলাম প্রতিষ্ঠা, এরূপ আমূল পরিবর্তন প্রায় দুরূহ বলা চলে। কারণ, ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, গণতন্ত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতবাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয় এবং সেখানে তাদেরকে তাদের নিজস্ব মত, চিন্তা ও মতাদর্শ প্রচারের অধিকারও মেনে নিতে হয়, যদিও তা স্পষ্টত ইসলাম ও উম্মাহর স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। অথচ সত্যিকার ইসলামী রাষ্ট্রে বাকস্বাধীনতার অধিকারের কথা বলে ইসলাম ও তার শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রচারণার কোনো সুযোগ নেই।

এ কথা স্বীকার্য যে, সমাজের যে কোনো বড়ো ধরনের পরিবর্তন, বিশেষ করে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন, স্বৈরাচারী সরকারের পতন, কোনো মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি সহজেই নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে খুব কমই সংঘটিত হয়। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনমত তৈরি ও গণজাগরণ। পৃথিবীতে যতবারই বড়ো ধরনের পরিবর্তন হয়েছে তা গণজাগরণের মাধ্যমে হয়েছে। সাম্প্রতিককালে চীনের সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা বলুন, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন বলুন, ইরানের বিপ্লব বলুন, আফগানিস্তানে ইমারতে ইসলামিয়্যাহর প্রতিষ্ঠা বলুন- কোনো পরিবর্তনই ভোটের মাধ্যমে হয়নি; গণজাগরণের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছে। এমনকি, বাংলাদেশে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আর দু হাজার চব্বিশে স্বৈরাচারের পতনও ভোটের মাধ্যমে হয়নি; গণজাগরণের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছে। মোটকথা, রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পক্ষে যদি ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা যায় এবং ইসলামের চাহিদাকে গণদাবিতে পরিণত করা যায়, তখনই গণজাগরণের মাধ্যমে ইসলামী ব্যবস্থা পরিপূর্ণরূপে কায়েম করা সম্ভব হতে পারে।

ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, এমন অনেক মুসলিম দেশ রয়েছে, সেগুলোতে যদি গণতন্ত্র সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে, তবে অল্প সময়ের মধ্যে সেসব দেশে ইসলামপন্থীরা সরকার গঠন করতে পারবে; তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় গিয়েও পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিবিধান চালু করা প্রায় অসম্ভবই বলা চলে। তারা আপাতত সেসব দেশে- যদি ইসলামী সরকার গঠিত হয়- যেসব কর্মসূচি নিয়ে এগুতে পারে তা হলো- সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে পারে এবং সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে ধীরে ধীরে- যতটা সম্ভব- ইসলামী বিধানগুলো কার্যকর করার পদক্ষেপ নিতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, একযোগে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিবিধান চালু করার উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে; ক্ষেত্রবিশেষে তা মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, এ অবস্থায় নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য, সকল নবী ও রাসূলই নিজ নিজ জাতিকে সর্বপ্রথম তাওহীদের দাওয়াত পেশ করেছেন। যখন কোনো জাতি এ দাওয়াত কবুল করতো, তখনই তাদেরকে ধীরে ধীরে অন্যান্য বিধানের প্রতি দাওয়াত দেওয়া হতো। মুসলিম উম্মাতের ওপর আল্লাহ তা‘আলার একটি বড় অনুগ্রহ হচ্ছে, তিনি শরীয়তের সকল বিধান একযোগে নাযিল করেননি; বরং ক্রমাগতভাবে শরীয়তের বিধানগুলো জারি করেছেন। তদুপরি অনেক বিষয়ের চূড়ান্ত বিধি-নিষেধ এক দিনেও কার্যকর করেননি। ইসলামের আবির্ভাবের সময় মদ্যপান ছিল তৎকালীন আরবের তথা গোটা পৃথিবীর মানুষের সাধারণ অভ্যাস এবং তারা মদ্যপানকে কোনোরূপ অপরাধযোগ্য কর্ম মনে করতো না। অনুরূপভাবে যিনাও ছিল তৎকালীন সমাজে বহুল প্রচলিত একটি সাধারণ চরিত্র। কিন্তু ইসলামে মদ্যপান, যিনা প্রভৃতি মারাত্মক দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে মানুষের এই চিরাচরিত অভ্যাস ও চরিত্র পরিবর্তন সাধনে ইসলাম ধীর পদক্ষেপে পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হয়েছে। কেননা, এসব বিষয়কে যদি হঠাৎ করে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হতো তাহলে তা মেনে চলা তখনকার লোকদের পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে পড়তো। অনেকেই হয়তো তা গ্রাহ্যই করতো না। এ প্রসঙ্গে উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা) বলেছেন,

‘‘.. কুরআনের প্রথম অবতীর্ণ সূরাগুলোর মধ্যে জান্নাত ও জাহান্নামের উল্লেখ রয়েছে। তারপর যখন লোকেরা দলে দলে ইসলামে দীক্ষিত হতে লাগলো তখন হালাল-হারামের বিধান সম্বলিত সূরাগুলো নাযিল হয়েছে। যদি শুরুতেই নাযিল হতো যে, তোমরা মদ পান করো না, তাহলে তারা অবশ্যই বলতো যে, আমরা কখনো মদপান ত্যাগ করবো না। যদি শুরুতেই নাযিল হতো যে, তোমরা ব্যভিচার করো না, তাহলে তারা অবশ্যই বলতো যে, আমরা কখনো অবৈধ যৌনাচার বর্জন করবো না।…” (বুখারী)

সাইয়িদুনা ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মদ (সা:)-কে পাঠালেন, এই দাওয়াত দেওয়ার জন্য যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্যিকার ইলাহ নেই। মুমিনরা যখন এই কথার স্বীকৃতি দিলো তখন তাদের ওপর সালাত ফরয করা হলো। যখন তারা সালাত বাস্তবায়ন করলো তখন তাদের ওপর সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো। যখন তারা সিয়াম পালন করলো তখন তাদের ওপর যাকাত ফরয করা হলো। যখন যাকাতের বিধান পালন করলো তখন হজ্জের বিধান দেওয়া হলো। যখন হজ্জের বিধান পূর্ণ করলো তখন জিহাদের বিধান প্রদান করা হলো। এরপর এই আয়াত অবর্তীণ করা হলো- আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” (তাফসীরে তাবারী) এসব রিওয়ায়াতে গুরুত্ব অনুযায়ী দাওয়াতের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষার শিক্ষা রয়েছে। তাই আমাদেরও ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখতে হবে। খলীফা উমর ইবনু আবদিল আযীয (রাহ.) সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে, খলীফা হবার পর তিনি শরীয়তের কিছু কিছু বিধান কার্যকর করতে সময় নিচ্ছিলেন। তখন তাঁর ছেলে আবদুল মালিক (রাহ.) এসব বিধানের দ্রæত বাস্তবায়নের কামনা পেশ করলে তিনি বলেন,

“হে স্নেহের পুত্র! তাড়াহুড়া করো না! কারণ, আল্লাহ তা‘আলাও পবিত্র কুরআনে প্রথম দুবার মদের নিন্দা করেছেন, তৃতীয়বারে হারাম করেছেন। আমার আশঙ্কা হয় যে, আমি যদি সকল লোককে একসাথে সকল সত্য মেনে চলতে নির্দেশ দেই, তাহলে তারা সকলেই মিলে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং এতে ফিতনা সৃষ্টি হবে।” (আল মুওয়াফাকাত) বর্তমানে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বর্তমানে বিশ্ব মোড়লরা আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বিশ্বায়নের কঠিন ফাঁদে ফেলে মুসলিম দেশগুলোকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে যেভাবে শাসন-শোষণ করছে, তাদের ওপর নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তাতে মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায়ন বা ইসলামী রাষ্ট্র কায়িম করা তো দূরের কথা, বরং স্বাধীনভাবে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করাও এখন দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বড়ো ধরনের কোনো পরিবর্তন সূচিত না হলে নিকট-ভবিষ্যতে প্রায় সকল দেশেই_ গণতন্ত্র বলেন, গণজাগরণ বলেন বা সশস্ত্র জিহাদ বলেন_ কোনো পদ্ধতিতেই ইসলামপন্থীদের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও ক্ষমতায় যাওয়া কঠিন, আবার কোথাও কোনোভাবে গেলেও স্বাধীনভাবে টিকে থাকা অনেক চ্যালিঞ্জিং ব্যাপার, যা মোকাবেলা করার মতো ইসলামী নেতৃত্ব ও মুসলিমমানস আজও মুসলিম দুনিয়ায় খুব একটা গড়ে ওঠেনি।

সুতরাং এ বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামপন্থীদের গণতন্ত্রের চর্চা, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই নয়; বরং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা ও অবস্থান উত্তরোত্তর দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করার উদ্দেশ্যেও হতে পারে। এরূপ প্রতিকূল রাজনৈতিক অবস্থায় ইসলামপন্থীগণ অন্তত গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে-যতটুকু সুযোগ পাওয়া যায় তার যথার্থ ব্যবহার করে- ক্ষমতার দৃশ্যপটে বরাবরই একটি বড়ো প্রেসার গ্রুপ/ইন্টারেস্ট গ্রুপ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন এবং এ প্রক্রিয়ায় দীন ও মিল্লতের স্বার্থ ও কল্যাণ- যতটা সম্ভব- আদায় করে নিতে পারেন। পক্ষান্তরে এ অবস্থায় যদি ইসলামপন্থীগণ মোটেরওপর গণতন্ত্রের চর্চা ত্যাগ করেন, নির্বাচন ব্যবস্থা বর্জন করেন, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে তারা ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে বাধ্য হবেন এবং এর ফলে ক্রমে তাদের অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা, সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখাও অনেকখানি কঠিন হয়ে যেতে পারে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ কথাটি আরও উত্তমভাবে প্রযোজ্য। সমকালীন বৈশ্বিক রাজনীতি ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, বিশেষ করে বর্তমান ভারতের পেটে বসে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায়ন বা ইসলামী রাষ্ট্র/খিলাফত/ইমারত কায়িম করা তো দূরের কথা; বরং স্বাধীনভাবে নিজেদের টিকে থাকা এবং সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোই এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। এমনকি, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশে ইসলামী শক্তির পক্ষে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কোনো সরকার গঠন করার কিংবা রাষ্ট্র তৈরি করার বা সমহিমায় টিকে থাকার চিন্তা করা যে একটা অপরিণামদর্শী ও অবাস্তব চিন্তা_ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই আপাতত ইসলামী দলগুলোকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়ে নিজেদের অবস্থান_যতটা পারা যায়_সুসংহত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, যতদিন না বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে আশানুরূপ কোনোরূপ পরিবর্তন আসে।

তবে এর মানে কখনো এ নয় যে, আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র/খিলাফত/ইমারত কায়েমের প্রচেষ্টা একেবারে ছেড়ে দেবো; বরং সার্বিক পরিস্থিতির প্রতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সময়োচিত ও বাস্তবসম্মত কর্মসূচি ও পরিকল্পনা নিয়ে আমরা আমাদের লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাবো, আমাদের প্রচেষ্টা প্রতিনিয়ত চালিয়ে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা_ চাহেন তো_ যেকোনো মুহূর্তে অবস্থা পরিবর্তন করে দিতে পারেন!! আমাদের কেউ কেউ আফগানিস্তানের উদাহরণ টানেন। তাদের কথা হলো, সেখানে যদি বিপ্লবের মাধ্যমে ‘ইমারতে ইসলামিয়্যাহ’ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে বা অন্য দেশগুলোতে পারা যাবে না কেন?! আমরা মনে করি, আফগানিস্তানের ইতিহাস ও এর ভৌগোলিক অবস্থার সাথে আমাদের ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থার ঢের পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, আফগানরা প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বিশে^র পরাশক্তিগুলোর সাথে লড়াই করে নিজেদের সক্ষমতার অনন্য নজীর স্থাপন করেছেন; এ দীর্ঘ সময় ধরে তারা প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন। বলতে গেলে, এ সময়ের মধ্যে আফগান শিশুরা মায়ের পেট থেকে বের হয়েছে বোমার আওয়াজ শুনে, যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে দিয়েই তারা বেড়ে ওঠেছে। এভাবে ক্রমে তারা এক ধরনের অজেয় শক্তিতে পরিণত হন এবং দেশটি পরিচয় লাভ করে ‘সাম্রাজ্যবাদের কবরস্থান’রূপে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশে^র সব পরাশক্তি দীর্ঘসময় সামরিক অভিযান পরিচালনার পরও আফগান জনগণকে নিজেদের করতলে আনতে সক্ষম হয়নি এবং শেষাবধি ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যাসবি বলেন,
‘‘যদি বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখা হয়, আফগানিস্তান একটি কঠিন জায়গা। এটি এমন এক জটিল দেশ, যেখানে অস্থিতিশীল অবকাঠামো, খুব সীমিত উন্নয়ন এবং অঞ্চলটির চারদিকে রয়েছে বিস্তৃত ভূমি। .. সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের সঙ্গে কোনো নমনীয়তা দেখায়নি। তারা নিজেদের পথে যেতে চেয়েছিল, অনেকদূর এগিয়েও যায়, কিন্তু তারা কখনও আফগানিস্তানের জটিলতা বুঝতে পারেনি।” বলতে গেলে আফগানিস্তান বর্তমানে এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, মনে হয় না যে, এখন অন্য কোনো শক্তি কথিত ওই কবরস্থানে আক্রমণের ঝুঁকি নেবে। দ্বিতীয়ত, তাদের ভৌগোলিক অবস্থানও আমাদের তুলনায় অনেক সুবিধাজনক; এটি প্রায়ই মুসলিম দেশগুলোর মধ্যস্থলে অবস্থিত, এর সীমানায় রয়েছে ইরান, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান প্রভৃতি দেশ। ওই সব দেশ থেকে বিভিন্ন সময় তারা নানাভাবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও রসদ প্রভৃতি সহযোগিতা পেয়েছে।

তৃতীয়ত, সেখানে জনসংখ্যার প্রায় ৯৯ শতাংশই হলো মুসলিম। ফলে দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু কর্তৃক কোনোরূপ ষড়যন্ত্র তৈরির সম্ভাবনাও ছিল না বললেই চলে। আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা ঠিক বিপরীত। কারণ, প্রথমত, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে দীর্ঘ সময় ধরে মোকাবেলা করে টিকে থাকার মতো দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন ত্যাগী জানবাজ লোক আজও এ দেশে খুব বেশি তৈরি হয়নি। দ্বিতীয়ত, প্রশ্ন হলোÑ দীর্ঘ সময় ধরে কোনো বড়ো শক্তির সাথে যুদ্ধ-সংগ্রাম চালিয়ে যাবার মতো প্রয়োজনীয় শক্তি-সামর্থ্য-রসদ-সরঞ্জাম আমাদের কতটা আছে?! ভারত যেভাবে বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের বেষ্টন করে রেখেছে সেই অবস্থায় থেকে বাইরের সহযোগিতা পাওয়াও আমাদের জন্য অনেক কঠিন ব্যাপার। তৃতীয়ত, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আজও ইসলামী বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত নয়। তারা ইসলামকে ভালোবাসলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক- তা আন্তরিকভাবে কামনা করে না এবং এ কারণে এতদুদ্দেশ্যে বড়ো ধরনের কোনো ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত নয়। চতুর্থত, বাংলাদেশ যদিও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য ভূমি; তবুও আমাদের পাশর্^বর্তী রাষ্ট্র ভারত তার স্বার্থে প্রতিনিয়ত সংখ্যালঘুদের একটি শ্রেণিকে দিয়ে নতুন নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। পঞ্চমত, আমাদের ইসলামী শক্তিগুলো সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ নয়। নিজেরা নানা দল-উপদল ও শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত এবং প্রায়ই নিজেদের অভ্যন্তরীণ কলহ-বিবাদে লিপ্ত থাকে। তদুপরি সামাজিক ও সেবামূলক কার্যক্রমে তাদের অন্তর্ভুক্তিও আশানুরূপ নয়। এ অবস্থায় আমাদের জনগণ তাদেরকে কোনোভাবেই রাষ্ট্রপরিচালনায় আস্থায় নিতে পারছে না।

কাজেই প্রত্যেকটি দেশকে তার নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, শক্তি-সামর্থ্য ও অবস্থান দিয়েই মূল্যায়ন করতে হবে; অন্য দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শক্তি-সামর্থ্য ও অবস্থান দিয়েই নয়। উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষেত্রবিশেষে ইসলামপন্থীদের পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব, এমনকি সরকারও গঠন করা যেতে পারে; তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, এ পদ্ধতিতে সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিপূর্ণরূপে ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।তবে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় কিছু সুবিধা লাভ করা যায়, যা অন্য কোনো শাসনব্যবস্থায় (যেমন- রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র প্রভৃতি) লাভ করা দুরূহ। নিম্নে এ সুবিধাগুলো উল্লেখ করা হলো-ক. ইসলামের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা যায় গণতন্ত্রে যেহেতু কথা বলার স্বাধীনতা থাকে, সভা-সমাবেশের অধিকার থাকে, অবাধ প্রচারণা চালাবার অধিকার থাকে, তাই এ সুবাদে সেখানে স্বাধীনভাবে ইসলামের প্রচারণা চালানো যায়, তার পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা যায়।

খ. ইসলামপন্থীদের ভিত্ মজবুত করা যায়
গণতন্ত্রে যেহেতু সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা দল, সংগঠন ও সমিতি গড়ে তোলা যায় এবং নির্বিঘেœ দলীয় ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়, তাই এই সুবাদে ইসলামপন্থীরাও সেখানে নিজেদের বিভিন্ন দল ও সংগঠন গড়ে তুলতে পারে এবং নির্বিঘ্নে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের ভিত্ মজবুত করা যায়। গ. রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা যায় গণতন্ত্রে যেহেতু সকলেই সমান অধিকার ভোগ করে, রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক তার সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুসারে প্রযোজ্য যে কোনো পদে অধিষ্ঠিত হবার অধিকার লাভ করে, তাই সেই সুবাদে ইসলামপন্থীদের পক্ষে সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে নিজেদের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করা সহজ হয়।

ঘ. সহজেই গণঅভ্যুত্থান ঘটানো যায়
গণতন্ত্রে যেহেতু নাগরিকরা স্বাধীনভাবে সভা-সম্মেলন-শোডাউন-মিছিল ইত্যাদি করতে পারে, তাই সেই সুবাদে সেখানে সহজেই গণঅভ্যুত্থান ঘটানো যায়, বিপ্লব ঘটানো যায়। ঙ. ইসলামবিরোধী সরকার পরিবর্তন করা যায় গণতন্ত্রে যেহেতু নির্দিষ্ট মেয়াদ অন্তর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পায়, তাই সেই সুবাদে জনমতের ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম-বিরোধী সরকার পরিবর্তন করা যায়, এমনকি কখনও ইসলামপন্থীরা সরকারও গঠন করতে পারে।

(রিপোস্ট)
(আপনার সুচিন্তিত মতামতের জন্য ধন্যবাদ)

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *