করোনা পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থার মহা সংকট উত্তরণে শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ন্যূনতম ১৫-২০% বা জাতীয় আয়ের ৪-৬% হওয়া প্রয়োজন বলে বাজেট প্রস্তাবনায় উল্লেখ করেছে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ।
৩০ মে ২০২২ সকালে ঢাকার সেগুনবাগিচাস্থ শিশু কল্যাণ পরিষদ কনফারেন্স হলে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি নূরুল করীম আকরাম-এর সভাপতিত্বে সংগঠনের পক্ষ থেকে বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করেন সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল শেখ মুহাম্মাদ আল-আমিন।
বাজেট প্রস্তাবনায় ৬টি বিশেষ খাতের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা ও ১৬ দফা দাবি পেশ করা হয়।
প্রস্তাবনাগুলো মধ্যে রয়েছে:
১. দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতি রোধ: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি বেসরকারি সেক্টরে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাজেটে প্রণোদনা ও বরাদ্দ থাকতে হবে, পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানি কমিয়ে দেশে উৎপাদনের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
২. শিক্ষা খাত: করোনা পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থার মহা সংকট উত্তরণে শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ন্যূনতম ১৫-২০% বা জাতীয় আয়ের ৪-৬% হওয়া প্রয়োজন করছে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশে তা জাতীয় বাজেটের মাত্র ১১.৯২ শতাংশ। বছরের পর বছর শিক্ষা খাতে কম বরাদ্দ রাখার ফলে জ্ঞান সূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। আমাদের ওপরে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভূটান, ভারত, পাকিস্তান রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে দেশের উচ্চশিক্ষা খাত ও গবেষণা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। কারিগরি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও কৃষি শিক্ষার প্রসারে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে।
৩. কৃষি খাত: বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটাতে আমদানি নির্ভর হতে হয়। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষক যেন দুশ্চিন্তায় নিপতিত না হয় এটা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
৪. স্বাস্থ্য খাত: বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের ষষ্ঠ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ আসছে নাগরিকদের পকেট থেকে, আর সরকারের কাছ থেকে আসছে ২৩ শতাংশ। এরপরেও দেশের সাধারণ জনগণ যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না।তাই স্বাস্থ্য খাতে গতানুগতিকভাবে বাজেটের ৫ শতাংশ বরাদ্দ না দিয়ে এই খাতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে।
৫. সামাজিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের হার উর্ধ্বমুখী। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৭৭ লাখের বেশি। বিআইজিডি ও পিপিআরসির সর্বশেষ জরিপ বলছে, দেশে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয় শুধুমাত্র নির্ধারিত কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের চরম দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই খাতে এই অর্থবছর (২০২২-২৩) বাজেটের ২০-২২ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে।
৬. শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থান: দেশে প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। যেখানে কর্মসংস্থানের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি খাতে আর ৯৫ শতাংশই বেসরকারি উৎসে। কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নির্ধারণ করা জরুরি। বেকার, দরিদ্র নারী ও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা উন্নয়নের লক্ষ্যে বাজেটে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নারীবান্ধব কর্মসংস্থান তৈরিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেটে উল্লেখিত ১৬ দফা দাবী নিম্নরূপ:
০১. সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে জনকল্যাণমুখী ইসলামী অর্থব্যবস্থা চালু করতে হবে।
০২. ঋণ নির্ভর বাজেট থেকে অতিদ্রুত ফিরে আসতে হবে।
০৩. প্রবৃদ্ধিতে অসমতা দূর করতে হবে।
০৪. অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে।
০৫. বিদেশ থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
০৬. অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে দামি কিছু বিলাসপণ্য আমদানি কয়েক মাসের জন্য বন্ধ করতে হবে।
০৭. নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ সচল রাখতে হবে। আমদানির ক্ষেত্রে খাদ্যসামগ্রীর করের হার কমাতে হবে।
০৮. আমদানি ও রপ্তানির সার্বিক মূল্যে ভারসাম্যতা আনতে হবে।
০৯. জনপ্রশাসনে বাজেট কমিয়ে ১২ শতাংশের বেশি দেয়া যাবে না। এছাড়াও প্রশাসনিক ব্যয় ও মন্ত্রী-আমলাদের বেতনে শতকরা ৬০ শতাংশ খরচ কমাতে হবে। সরকারি গাড়ি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় শতকরা ৫০ শতাংশ কমাতে হবে।
১০. দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং মূল্যস্ফীতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১১. কর ফাঁকি এবং মুদ্রা ফাঁকি বন্ধ করতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১২. কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে।
১৩. অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যেমন বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা ইত্যাদি।
১৪. বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের কর ফাঁকি বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা। এই বিশাল কর ফাঁকি রোধ করে কর আদায় করতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১৫. বিদেশে টাকা পাচার রোধ, ঋণখেলাপী বন্ধ করতে, এবং সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে ১০ টাকার জিনিস হাজার টাকায় ক্রয়ের মত জালিয়াতি বন্ধ করতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১৬. বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াবে না এমন অবকাঠামো খাতে এ বছর বাড়তি অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করতে হবে।
বাজেট প্রস্তাবনা অনুষ্ঠানে আরও আলোচনা করেন ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ-এর জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেল ইউসুফ আহমাদ মানসুর, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মাদ ইবরাহিম হুসাইন মৃধা, প্রশিক্ষণ সম্পাদক নূরুল বশর আজিজী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সুলাইমান দেওয়ান সাকিব, দফতর সম্পাদক মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম, প্রচার ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক মুনতাছির আহমাদ, বিশ্ববিদ্যালয় সম্পাদক মাহবুব হোসেন মানিক প্রমুখ।
Leave a Reply