শনিবার , ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সুভা দি আর বিকাশ দার প্রেমের কাহিনীর সূত্রপাত হয় আমাদের হাত ধরে

প্রকাশিত হয়েছে-

ওমর ফারুকঃ- উখিয়া,

আমাদের বলতে আমি, টুকু,পদ্মা আর লতা।আমাদেরকে বিকাশদা পড়াতেন।আর গ্রামে সবথেকে বড় ঘর প্রভা দিদিদের।যার কারণে আমরা চারজন প্রভাদীর বাড়িতে গিয়ে পড়তাম আর বিকাশ দা ও সেখানে আসতেন।
আর তাদের প্রেমে ডাকপিয়নও ছিলাম আমরা চারজন।প্রভা দি আমাদের স্কুলে পড়তো।স্কুলে আসা যাওয়ার পথে প্রভার দিকে টুক করে বিকাশ দার দেয়া চিঠি হাতে গুঁজে দিতাম আর দৌড় দিতাম। রক্ত শপথ করে আমরা বিকাশ দা আর প্রভাদি দিকে প্রমিস করেছি,এই কথা আমাদের চারজনের বাইরে কেউ জানবেনা।

রক্ত শপথ ছিলো এরকম,সুই দিয়ে কুট করে একটু ফুটো করতে হয় আঙুল।সেখান থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে একটা পেরেক বসানো কাঠে লাগাতে হয়।লাগিয়ে তা মাটিতে পুঁতে দিতে হয়।আমরা কথা ভাঙ্গলে কাঠের পেরেক বড় হতে থাকবে।সেই পেরেক নড়তে পারে।যে কথা ভাঙ্গবে তার পেট ফুটো করে দিবে পেরেকটা।আমরা চারজনে তাই নিজেদের সাথেও বিকাশ দার প্রেম কাহিনী আলাপ করিনা।

বিকাশ দার চিঠির সাথে চারটে চকলেটও দিতেন।চকলেট গুলো আমাদের জন্য।আর চিঠি প্রভাদিদির জন্য ।কিন্তু আমাদের সুখের দিন শেষ হয়ে গেলো একদিন।বিকাশদা কলেজে পড়ার জন্য শহরে পাড়ি জমায়।সেদিন প্রভাদির সাথে আমরাও কেঁদেছিলাম জামতলায় বসে বসে।প্রভাদি কেঁদেছে বিকাশদা দূরে চলে যাচ্ছে তাই। আর আমরা কেঁদেছি চকলেট পাবো না আর,তাই!
কয়দিন পর সত্যিকারের ডাকপিয়ন আসে।আমরা তখন স্কুল থেকে বাড়ি যাচ্ছিলাম।ভাগ্য ভালো বলতে হবে!পথেই চিঠি নিয়ে নিলাম আমরা।বাড়িতে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো।তারপর থেকে আমরা চিঠি আসার দিনে স্কুল থেকে ফেরার পথে জামতলায় দাঁড়াতাম।

পিয়ন এসে চিঠি বাড়িতে দিতে পারতো না আর।আমরা পথেই নিয়ে নিতাম।
এরকম করতে করতে ফাইনাল পরীক্ষা চলে এলো।এবং আমরা পড়লাম বিপদে।বিপদের সূচনা এভাবে,
চিঠি যেদিন আসবে সেদিন টুকু জামতলায় দাঁড়ানোর কথা ছিলো।কিন্তু টুকুর বাবা বাজার থেকে আসার সময় তাকে জামতলায় দেখে কান ধরে বাড়িতে নিয়ে এসে পড়তে বসিয়ে দিলো।আর চিঠি নিয়ে পিয়ন সোজা আমাদের বাড়িতে চলে এলো।চিঠিটা পড়লো মায়ের হাতে।বাবার হাতে পড়লে রক্ষে ছিলো।

কিন্তু আমার মা সাক্ষাত দারোগা।মাকে সবাই ভয় পায়।আর মা যখন চিঠি পড়লো তখন মহা বিপদের ঘন্টি বাজলো কোথায় যেনো।তারপর দেখলাম ঘন্টি না।আসলে আমার কানে মায়ের হাতের থাবড় লেগেছে।
মা ভেবেছে কোন ছেলে আমাকে চিঠি লিখেছে।মাত্র সিক্সে পড়ুয়া মেয়ের কাছে কারো চিঠি!এরকম ভাবাটা আসলে অন্যায় না।কারণ চিঠিতে প্রভা দিকে বিকাশদা ময়না পাখি বলে সম্বোধন করেছে আর বিকাশদা নিজের নামের জায়গায় লিখে,”তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামী!”
আমাকে বেধড়ক পেটানোর পর চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দেয়া হয়।তবে আমার পেট থেকে কথা বের করতে পারেনি মা।
তারপরের বিপদটা হয় সাংঘাতিক!পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমরা সবাই নানীবাড়ি যাই।টুকু গ্রামে ছিলো আমাদের চারজনের মধ্যে।টুকুর বাবার হাতে পড়ে চিঠি।টুকুকে পিটিয়ে কথা বের করে নেয় তার বাবা।আর তারপরের ঘটনা খুবই বেদনাদায়ক।

প্রভা দিকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় এক সপ্তাহের মধ্যে।বিকাশদা খবর পায় বিয়ের পরেরদিন।ছুটে আসে গ্রামে কিন্তু প্রভাদি তখন শ্বশুরবাড়িতে।এবার বিকাশদার সাথে আমরা চারজন খুব কাঁদি।বিকাশদা প্রভাদির জন্য আর আমরা দুজনের জন্য কাঁদতে থাকি।
এরপর বিকাশদা শহরে চলে যায়।আর সবাই প্রভাদির কথা বেমালুম ভুলে যাই।প্রভাদি যখন গ্রামে আসে তখন প্রতিবারই তার চোখ মুখ শুকনা লাগে।মুখে আগের মতো হাসি নেই।শুধু আমাদেরকে দেখলে একটু হাসে।
একদিন আমরা স্কুল থেকে বাড়িতে ফেরার সময় প্রভাদির বাড়িতে খুব চিৎকার শুনতে পাই।প্রভাদির বর চিৎকার করে কি কি যেন বলছে।পরে শুনলাম প্রভাদি নাকি পালিয়েছে।গ্রামের সবাই বিকাশদাকে খবর দেয়।বিকাশদা অবাক হয়।

কারণ প্রভা দি তার কাছে যায়নি।বিকাশ কে প্রভাদির বর হুমকি ধমকি দিয়ে চলে যায়।তার পরদিন হিজিলিয়া খালে প্রভাদির লাশ ভেসে উঠে।আর বিকাশদা একটা দা নিয়ে প্রভা দির বরের গলা কেটে দিলো।বিকাশদাকে পুলিশে নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা চারজন আবার কাঁদলাম।
প্রভাদির পোস্টমর্টেম রিপোর্টে আসে,অনেক অত্যাচার করে মেরে গঙ্গায় ফেলে দেয়া হয়েছিলো তাকে।প্রভাদির শ্বশুরবাড়ির লোক পরে স্বীকার করে পুরোটা।প্রভাদি নাকি খুব চুপচাপ চলতো।বারবার তার বর তাকে বিকাশদার কথা বলে বলে মারতো।প্রভাদি চুপ করে থাকতো।কখনো টুঁ শব্দ করেনি।শেষদিন মারের চোটে মরেই যায় প্রভাদি।

তারপর কেটে যায় ১৪ বছর।বিকাশদা যাবতজীবন কারাদন্ড থেকে মুক্তি পায়।আর গ্রামে সবাই বিকাশ পাগলা বলে চিনতে থাকে।ছোট বাচ্চারা দুষ্টুমি করলে বাবা মা ভয় দেখায়,”বিকাশ পাগলার কাছে দিয়ে আসবো একদম!”
বাচ্চারা ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে যায়।আর আমরা চারজন এখনো মাঝে মাঝে জামতলায় বিকাশদার সাথে বসে বসে কাঁদি।

লেখক
ওমর ফারুক
শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক
আলোকিত ফ্রেন্ডশিপ ক্লাব কক্সবাজার( উখিয়া)
মোবাইলঃ- 01857-621831