কায়েস ও নাবিল ছোটকাল থেকেই বন্ধু।লেংটাকালে তারা একই সাথে গ্রামের মক্তবে লেখা-পড়া করেছে। পাশাপাশি প্রাইমারি স্কুলে যেতো। প্রাইমারি লেভেল শেষ করার পর একজন চলে যায় সুদূর হাটহাজারি মাদরাসায় আর নাবিল পাশের গ্রামের একটি দাখিল মাদরাসায় ভর্তি হয়। উভয়ে লেখা-পড়ায় খুব ভালো। নাবিল দাখিল পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে। তাই চিন্তাভাবনা করে আলিমে ভর্তি না হয়ে কলেজে ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হলো।
হঠাৎ একদিন নাবিলের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। পারিবারের সম্পদ বলতে শুধু একটি গরু ছিলো। বাবার চিকিৎসার খরচ যোগাতে গিয়ে গরুটি বিক্রি করে দিতে হলো। তবুও বাঁচানো গেলো না। চলে গেলো তাঁর প্রভূর সান্নিধ্যে।
এখন পরিবারের হাল তাকেই ধরতে হচ্ছে। কারণ পরিবারে সেই বড়। তাছাড়া ছোট একটি বোন আছে। ছোট বোনের লেখা-পড়ার খরচ এবং নিজের লেখা-পড়ার খরচ কিভাবে যোগাবে! তাই নিরূপায় হয়ে বহু চেষ্টার মাধ্যমে একটি ব্যবসার হাল ধরলো। সুদূর সিলেট থেকে চা পাতা সংগ্রহ করে গ্রামের এবং পৌরসভার বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই দেয়। এভাবেই চলছিলো তার দিনকাল।
একদিন পথিমধ্যে তার ছোটকালের বন্ধু কায়েসের সাথে দেখা হয়ে গেলো। সাথে সাথে কায়েস সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলো নাবিলকে। তারপর পথে দাঁড়িয়েই অনেক্ষণ কথা হলো। কথাচ্ছলে নাবিল কায়েসকে বললো- বন্ধু! কী করি বলতো, পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে কী ব্যবসা একটা ধরলাম। কিন্তু পদে পদে লস খাচ্ছি।
-তার আগে বল, তোর লেখা-পড়ার কী অবস্থা? কেমন চলছে?
-ধুর বেড়া, তোকে বললাম ব্যবসায় লসের কথা, আর তুই চলে গেলি লেখা-পড়ায়।
– তো কি, লেখা-পড়া বাদ দিয়ে দিবি?
– হ্যাঁ, এতো লেখা-পড়া দিয়ে কী করবো! অনেকেই তো মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি না পেয়ে ভবঘুরে হয়ে গেছে। তাই লেখা-পড়া ইচ্ছা আর নেই।
– না, আমি বলবো তুই লেখা-পড়া কর। আল্লাহ নিরাশ হতে নিষেধ করেছেন।তুই না মাদরাসায় পড়েছিস? তোর জানার কথা। সূরা যুমার এর ৫৩ নং আয়াতে আছে- “ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।” আমাদেরকে সবসময় তাঁর রহমতের আশা রাখতে হবে।লেখা-পড়া দিয়ে কী করবো? এই চিন্তা বাদ দে।তুই লেখা-পড়া চালিয়ে যা। সাথে ব্যবসাটা কর।লেখা-পড়ার খরচ যোগাতে হবে। দেখবি, আল্লাহ রহম করে এমন একটি ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন, যা তুই কোনদিন কল্পনা্ও করিসনি।
– তুই আশার কথা শোনালি বন্ধু! আমি যে একদিন মাদরাসার ছাত্র ছিলাম, তাও ভুলে গেছি। যাক তোর কথা মানবো। আল্লাহর রহমতের আশা রাখবো।তিনি একদিন চোখ তুলে তাকাবেন। কিন্তু বন্ধু! ব্যবসাটা যে আর ভালো লাগে না।
– তুই যেন কী ব্যবসা করিস? ও হ্যাঁ! দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়ানো। তাই না?
– হ্যাঁ, এই রকমই। চা পাতা বিক্রি করি। সকালে বের হয়ে দোকানে দোকানে চা পাতা দিয়ে আসি। আর সন্ধ্যায় গিয়ে টাকা উঠিয়ে নিয়ে আসি। অনেকে আবার “কাল দেবো, পরশু দেবো” বলে সময় ক্ষেপণ করে, যা আমার নিজেরও লজ্জা লাগে।
– আচ্ছা, এক কাজ কর, তোর কাছে এখন টাকা আছে?
– পকেট শূন্য।
– আরে ভাই, পকেটের কথা বলিনি। জমানো কত আছে?
– নাই।
– মিথ্যা বলছিস কেন? এতদিন তো ব্যবসা করলি। জমানো থাকবে না, এটা অবিশ্বাস্য।
– হ্যাঁ, অল্প কিছু্ আছে।
– তাহলে প্রথমে মিথ্যা বললি কেন? জানিস না মিথ্যা বলাটা মোনাফেকি অভ্যাস? তুই তো মাদরাসায়ও পড়েছিস!
– তুই এতো সিরিয়াসলি নিবি ভাবিনি।
– সিরিয়াস নিতে হবে। কারণ, মিথ্যা বলা অভ্যাসটা দুষ্টুমিচ্ছলেই হয়। আমার বন্ধুর পরিচয় মোনাফেক হোক, তা আমি চাই না।
– ধন্যবাদ বন্ধু! তুই সবসময় আমার ভালোটাই দেখিস। এখন বল, কেন টাকার কথা জিজ্ঞেস করছিস? ভালো কোন বুদ্ধি বা আইডিয়া দিবি নাকি?
– হ্যাঁ, বুদ্ধি বা আইডিয়া, দুনোটাই বলতে পারিস। তুই তো ডিজাইনের টুকটাক কাজ জানিস, কয়েকমাস সময় দিয়ে গ্রাফিক্সের একটা কোর্স কর। ডিজাইনের এখন অনেক দাম। তুই যেহেতু মাদরাসায় পড়েছিস, ইংরেজী অবশ্যই জানিস। Fiver, Freelancer.com এরকম কিছু সাইট আছে, যেখানে প্রচুর ডিজাইনের কাস্টমার আছে। দেখবি, ভলো ইনকাম হচ্ছে। আর ফেসবুকে এরকম কিছু গ্রুপ আছে, যেখানে ডিজাইনের কাস্টমার লাইন ধরে থাকে।
– তুই এত জানিস কিভাবে? আমি তো মনে করতাম কওমীরা কুরআন-হদীস ছাড়া কিছুই বুঝে না।
– তোর ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। বর্তমানে অনলাইন, বিশেষকরে রেডিও, সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যানসিং অর্থাৎ এমন কোন জগৎ নেই যেখানে কওমী আলেমদের পদচারণা নেই। যাক, এসব বিষয় আরেকদিন আলোচনা করা যাবে। এ রাস্তায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কথা বলা যায় না। কী বলেছি মনে আছে তো? তাড়াতাড়ি গ্রাফিক্সের কোর্সে ভর্তি হয়ে যা। তার আগে দোকানে চল।
– ও…. বুঝতে পেরেছি। তোর পানের টক উঠেছে। আচ্ছা, বলতো- তোরা কওমীরা এতো পান পান করিস কেন?
– হা হা হা…. উর্দূ একটি প্রবাদ আছে “হাত ম্যায় লঠি মুহ ম্যায় পান, ইয়ে উলামায়ে দেওবন্দ কা শান।”
(রচনাকাল- ১২/০৯/২০২১)
Leave a Reply