সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন।।। উখিয়া ভয়েস ২৪ ডটকম
চালিয়ে যাও
বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২০
UkhiyaVoice24.Com
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলা আওয়ামিলীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী”র ফেসবুক পোস্ট তুলে ধরা হল।
১০/০৮/১৯৭৫ রবিবার,
তখন আমি কক্সবাজার কলেজের অধ্যাপক ছিলাম,সারা বাংলাদেশে চলছিল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড,যাকে বলতে হবে দুর্ভিক্ষ কবলিত দেশকে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা।
দেশের প্রত্যেকটি মহকুমায় গভর্নর নিয়োগ হচ্ছে সাথে গভর্নরদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
কক্সবাজারের আমার পরম শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তি “জহিরুল ইসলাম” সাহেব তখন গভর্নর পদে প্রশিক্ষন এর জন্য ঢাকায় অবস্থান করছেন।ওইদিন খবর পেলাম মহকুমার পরে উপজেলা ভিত্তিক প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে,কয়েকদিনের ঢাকা যেতে হবে।বিকেল বেলা বেশকয়েক জন আওয়ামীলীগ নেতার কর্মীর সাথে দেখা হল একে অন্যের সাথে মতামত আদান প্রদান করলাম,সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হলো ১২/০৮/১৯৭৫,ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিব।এরমধ্যে আমার সাথে টেকনাফ, বাহারছডার পরম শ্রদ্ধেয় নেতা মরহুম শামসুদ্দিন(চেয়ারম্যান) সাহেবের সাথে দেখা হয়,ওনিও এই বিষয়ে অবগত আছেন,উনাকে আমাদের সাথে ঢাকা যাওয়ার কথা বললাম,উনি যাবেন বলে সম্মতি প্রকাশ করলেন।
প্রত্যেক উপজেলা থেকে আওয়ামীলীগে নেতা কর্মী ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে,
টেকনাফ উপজেলা থেকে শুধু আমি আর শামসুদ্দিন সাহেব ছিলাম।
১২/০৮/১৯৭৫ মঙ্গলবার
সবার মাঝে যেন উৎসবে আমেজ কারণ বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হবে,কথা হবে,নেতা কর্মীরা ৪/৫ জন করে কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে গেলেন। আমরা সাথে ছিলেন চকরিয়ায়র গোলাম রাব্বানি সাহেব,রামুর বদি আলম সাহেব আর কক্সবাজারের কামাল হোসেন চৌধুরী সাহেব।
অবশেষে ঢাকার উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু,,
বাহন ছিল তৎকালীন কাঠ আর সিটের তৈরী বডির চেয়ার কোচ,তাও আবার একটি নয়,কয়েকটি পরিবর্তন করে পৌছাতে হবে।
অনেকটা পথচলা কিন্তু কারো মাঝে যেন সেই ক্লান্তির চাপ নেই,গল্প আর রাজনৈতিক আলাপ চলছে সবার মাঝে।
১৩/০৮/১৯৭৫ বুধবার
ঢাকায় পৌছে,তৎকালীন “হোটেল সালিমারে” উঠলাম আমরা। বিকেলে ধানমন্ডি ৩২নাম্বার “বঙ্গবন্ধুর” বাসার দিকে গেলাম অনেক কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে দেখা হল একে অপরের খোজ খবর নিচ্ছিলেন,তখন “বঙ্গবন্ধু” বাসায় ছিলেন না একটি মিটিং ছিলেন।প্রায় রাত 8 টার দিকে হোটেলে ফিরে আসি,
কক্সবাজারের আরো কিছু নেতা কর্মী ছিলেন হোটেল সম্রাটে।
“১৪/০৮/১৯৭৫ বৃহস্পতিবার”
দুপুর বেলা হোটেল থেকে বের হয়ে হোটেল সম্রাটের দিকে গেলাম,তখনো “বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার সিডিউল ঠিক হয়নি। ঢাকায় অবস্থানরত কক্সবাজারের নেতা কর্মী সবাই আছেন,সিডিউল এর ব্যপারে কে কি শুনছে তা একে অপরকে বলতেছেন,হঠাৎ দেখতে পেলাম তৎকালীন মুসলিম লীগের দুজন অন্যতম নেতা হ্নীলার আব্দুল গফুর চৌধুরী আর কুতুবদিয়ার জালাল আহমেদ চৌধুরী কে,
উনাদের দেখার পর আমাদের সবার যেন কৌতুহল বেড়ে গেল,কি জন্য বা কি কারনে ঢাকায় আসলো?
আব্দুল গফুর চৌধুরীর সাথেই সেইদিন আমার কথা হয়নি,তবে জানতে পারলাম কক্সবাজারের একজন সিনিয়র নেতার মাধ্যমে “বাকশালে” যোগদান করতে এসেছে।
রাতে হোটেল ফিরে এলাম,ঘুমানোর আগে অনেকটা দুঃখ ভরা মন নিয়ে একজন বলে উঠলো “দেখেছ মানুষ স্বার্থের জন্য কতকিছু করতে পারে,যারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ছিল,যারা এই দেশের স্বাধীনতা বিরোধী ছিল,যারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধী ছিল,তারা আজ আবার বঙ্গবন্ধুর বাকশালে যোগদান করতে এসেছে!!
১৫/০৮/১৯৭৫ শুক্র বার
যে রাত্রি আমার অতিবাহিত করে আসলাম সেটি ছিল ভয়ানক,কলংকিত ঘুটঘুটে আধারে ঢ়াকা একটি কাল রাত।
সকাল ৭টা কি ৮টা হোটেল সালিমারের একজন বয় রুমের দরজায় এসে চিৎকার দিতে দিতে বললেন: সাহেবরা উঠেন,সাহেবরা উঠেন,বাংলাদেশ কে শেষ করে ফেলছে ওরা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে!!
আমরা সবাই তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে রিসিপশনের দিকে গেলাম সিলেটের এক ভদ্রলোক রেডিও নিয়ে খবর শোনছেন আর চোখ দিয়ে অবিরত পানি পড়ছিল।
তখনো আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে আর নেই,কতক্ষণ আর আবেগকে দমিয়ে রাখব,সেইদিনের সেই কঠিন বাস্তবতা আমাদের হার মানিয়েছিল,তবে আমরা মেনেনিতে পারিনি যে বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই।
হোটেল থেকে বের হলাম কিন্তুু কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না রাস্তায় যানবাহন নেই শুধু সেনাবাহিনীর গাড়ি আর কামানবাহী টেংকার
সমস্ত জায়গায় কার্ফিউ।নিস্তব্ধ ঢাকা শহর আর রক্তে রঞ্জিত সেই ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়ীটি,
শ্রাবনের বৃষ্টিতে যেন বঙ্গবন্ধুর রক্ত রাজপথে গড়িয়ে যাচ্ছে।ভাবতে পারিনি আমাদের আনন্দ রক্তস্রোতে ভেসে যাবে,ভাবতে পারিনি আমরা অভিবাবক হীন হবো।আমাদের একটি মিনিট পারহচ্ছে যেন বিভিষীকাময় কয়েকটি বছরের মত থামানো যাচ্ছেনা অস্রুজল।পরের দিনই কার্ফিউ বের হতে পারছিনা ৪/৫ জনের জমায়েত পেলে সেনাবাহিনীর লাঠিপেটা আর বেপরোয়া নির্যাতন মনে হচ্ছে যেন একটি স্বাধীন দেশ হায়েনার রাজ্যে পরিনত হল।
হোটেলের লবিতে পায়চারী আর নতুন কাউকে দেখলে জিজ্ঞাসা করি কোন কিছু জানেন কিনা বা কোনকিছু শুনছেন কিনা?দিন গড়িয়ে যেন রাত আসতেছে না,আমারা অনেকটা দিশেহারা,মনে হচ্ছে মধ্য সাগরে নাবিক হীন একটি তরী তে আমরা ভাসছি।
১৭/০৮/১৯৭৫ রবিবার,
সকালে আমরা সাহস করে দুই জন বের হলাম বাকি দুজন একটু পরে বের হলেন,প্রথমে গেলাম হোটেল সম্রাটে,হোটেলে ঢুকতে দেখলাম আব্দুল গফুর চৌধুরী রিসিপশনের সামনে বসে আছে,আমাকে দেখা মাত্র একটা অট্টহাসি দিয়ে বললেন
মো:আলী “আমারা যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি””আর ইংরেজীতে বললেন “”Right time right step”
খুবই খারাপ লাগলো এই কথা গুলো শোনার পর,আমি কিছু না বলে হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম সাথে বাকি তিন জন।
কে কোথায় আছে কিছুই জানি না আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কক্সবাজার ফিরে আসবো তবে কিভাবে?
আমরা দুজন করে হাটতে থাকলাম নিজেকে তখন অনেক বেশী কাপুরুষ মনে হচ্ছিলো কারণ বঙ্গবন্ধুকে ওরা শেষ করে ফেললো আর আমাদের চোখের সামনে হায়নারা উল্লাস করছে।
হাটতে হাটতে দাউদকান্দি পর্যন্ত এলাম চারদিকে নিরবতা কয়েক ঘন্টা পর দুই একটি গাড়ি দেখা যাচ্ছে,,কখনো হাটছি আবার কখনো রিকসা বা ভ্যান আবার কখনো চান্দের গাড়ি,এমন করতে করতে দুইদিন পর কক্সবাজার এসে পোচালাম।কক্সবাজার কলেজ ক্যম্পাসে এসে পতিবাদ মিছিল করে ছিলাম,দেখলাম স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি কাঁদছে আর সেই দিনের কুলাঙ্গার বিপক্ষ শক্তি উল্লাসে মেতে উঠেছে।
১৯৭৬, তৎকালীন জিয়াউর রহমান একটি জেনারেল অর্ডার জারি করলেন যাতে লিখা ছিল secure arrest atlist two “Awaime gonda elements” in every tana
আর এই অর্ডারে আমাকে দোষী সাবস্ত করা হয়।বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল আর আওয়ামী গোন্ডা আক্ষিত করে আওয়ামী রাজনীতি করার অপরাধে আমাকে কলেজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।তবে গর্ববোধ করি রাজনীতি আর প্রতিবাদ করার জন্য চাকরিচ্যুত
হলাম।
সেইদিনের খুনিদের উদ্দেশ্যে বলছি “তোমার পেরেছ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে কিন্তুু তোমারা পারোনি তার আদর্শ এই দেশ থেকে মুছে দিতে”
আজও আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ দীর্ঘ দেহ, সফেদ
পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো মুজিব কোট,পেছনে আচড়ানো কাঁচা-পাকা চুল, কালো মোটা ফ্রেমের
চশমা, হাতে পাইপ,শুধু সে পাইপ থেকে এডিনমুর’স তামাকের
সুবাস বের হয় না৷
যতদিন রবে পদ্মা,মেঘনা,গৌরী,যমুনা আবহমান ততদিন রবে কৃর্তি
তোমার শেখ মুজিবুর রহমান “”
অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী
সাবেক সংসদ সদস্য,
উখিয়া -টেকনাফ,
সভাপতি
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামীলীগ।
Leave a Reply