শনিবার , ২৮শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ১৩ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - শীতকাল || ২৬শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

সরকারি সুবিধা ও চাপের কাছে গৃহবন্দী হেফাজত।। উখিয়া ভয়েস২৪ ডটকম

প্রকাশিত হয়েছে-

 

  • আলমগীর ইসলামাবাদী
    চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি

সরকারি সুবিধা ও চাপে ফ্যাসিবাদের কব্জায় বন্দি হয়ে পড়েছে হেফাজত। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ধূমকেতুর মত জেগে উঠা অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজত। নানামুখী দ্বন্দ্ব এবং ধারা উপ-ধারায় সংগঠনটি এখন বিভক্ত। ২০১৩ সালের ৫ মে বিডিআর, র‌্যাব ও পুলিশের আক্রমণে নিশিরাতে রক্তাক্ত মতিঝিলের হেফাজত, আর আজকের হেফাজতে ফারাক অনেক। যেই ফ্যাসিস্ট সরকার মতিঝিলকে রক্তাক্ত করেছিল, সেই সরকারের নিকট থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে এবং নানামুখী চাপে অনেকটাই আদর্শচ্যুত হয়ে পড়েছে কওমি ওলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে গঠিত এ সংগঠনটি।

কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক এই সংগঠনটির আমীরের বয়স নব্বইয়ের ঊর্ধ্বে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় আল্লামা শাহ আহমদ শফী এখন বয়সের ভারে ঠিকমত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। ফলে তাকে ঘিরে এক ধরনের সুবিধাভোগী চক্র গড়ে উঠেছে। এই সুবিধাভোগী চক্রটি সরকারের প্রলোভনে নতি স্বীকার করে বিভিন্ন ধরনের আপোষ করছেন বলে আলেমদের একটা বড় অংশ মনে করছেন।

সরকারের সঙ্গে আপোষের বিরোধিতা করায় হেফাজতে ইসলামে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন সংগঠনটির সেক্রেটারি আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। এতে সংগঠনটির নেতাকর্মীরাও হয়ে পড়েছেন বিভক্ত। এই বিভক্তি এবং কাঁদা ছোড়াছুড়ির স্পর্শ লেগেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। ইদানীং ফেইসবুকে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে নানা প্রচারণায় লিপ্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে।

এদিকে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ বেশিরভাগ আলেম সরকারের চাপে এবং মিথ্যা মামলা, নির্যাতন ও গুমের ভয়ে মুখ খুলছেন না। এমনকি আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর বাড়ির সামনে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। পোশাকে এবং সাদা পোশাকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি রয়েছে তাঁর বাড়ির সামনে।

উল্লেখ্য, নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি ও ধর্ম অবমাননাকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন প্রণয়নসহ ১৩ দফা দাবিতে জেগে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ২০১৩ সালের মার্চ, এপ্রিল এবং মে মাসে সংগঠনটির বিভিন্ন কর্মসূচিতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মত। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল এবং ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে দেশব্যাপী গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল এই সংগঠনকে ঘিরে। তখন দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনায় আসে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে গঠিত এ সংগঠনটি। এতে ইমান-আক্বিদার পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে মানুষ নূতন আশার আলো দেখতে শুরু করে।

৫ মে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে রাতের আঁধারে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে হেফাজতের সমাবেশে চালানো হয় হত্যাযজ্ঞ। এরপর প্রধানমন্ত্রী একদলীয় জাতীয় সংসদে দাড়িয়ে আল্লামা শফিকে তেঁতুল হুজুর অবিহিত করে অশ্লীলভাবে সমালোচনা করেছিলেন। ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে তিনি বলেন, শরীরে লাল রং মেখে শুয়ে ছিলেন হেফাজতের কর্মীরা। পুলিশের উপস্থিতি ঠের পেয়ে লাশ উঠে দৌড় দেয় বলেও তিনি ব্যঙ্গ করেন। অথচ, এই সংগঠনের নেতারাই বিভিন্ন সুবিধার কাছে নতি স্বীকার করে পরবর্তীতে শেখ হাসিনাকে কওমি জননী উপাধিতে ভূষিত করেন।

হেফাজতের সমাবেশে বিডিআর-র‌্যাব ও পুলিশের ক্র্যাকডাউনের গ্রাফিক ছবি ও ভিডিও ফুটেজে ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের রাস্তায় রাস্তায় রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিলো তখন।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকার সেই সময় অনুসন্ধান চালিয়ে জানিয়েছিল যে, ৬১ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
হেফাজত নেতারা তখন দাবী করেছিলেন, শুধু ৫ মে’র অপারেশনে ২০০ শহীদের অধিক তালিকা তাদের কাছে রয়েছে। তবে সরকারি হুমকি এবং শহীদদের পরিবারে হামলার আশঙ্কায় প্রকাশ করা হচ্ছে না।

হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেছিলেন, অপারেশনে শত শত লোক নিহত হয়েছে।

শাপলা থেকে গণভবন: আঁতাত! নাকি আ’লীগের ফাঁদে ধরা?

২০১৪ সালের ভোটার বিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর হেফাজতকে কব্জায় নেয়ার কৌশল নেয়। আওয়ামী লীগের কৌশলের ফাঁদে ধরা দেয় হেফাজতের একটি অংশ। হেফাজতের ভেতরে অভিযোগ রয়েছে, সরকারি কৌশলে আওয়ামী লীগের পুতুলে পরিণত হন আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানী। তাঁকে ঘিরেই এখন হেফাজতে মূল দ্বন্দ্ব। হঠাৎ করে তাঁর সম্পদ ও দেশে বিদেশে বিনিয়োগ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হেফাজতকে কব্জায় নিতে প্রথমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক ডিজি ও আওয়ামী লীগ সমর্থক মরহুম শামীম মোঃ আফজালকে দায়িত্ব দেয় সরকার। শুরুতে তিনি তেমন পাত্তা পাননি আল্লামা আহমদ শফির কাছে।

পরবর্তীতে আল্লামা আহমদ শফির এক আত্মীয় ও সাবেক এক মন্ত্রীকে আপোষ রফার দায়িত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। হেফাজতকে কব্জায় নিতে সেই মন্ত্রী প্রথম দিকে কিছুটা সফলও হন। এরপরই শুরু হয় হেফাজতকে গণভবনে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া। ২০১৭ সালের ১১ই এপ্রিল হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফিসহ ৩ শতাধিক আলেমকে গণভবনে দাওয়াত দেয়া হয়। দাওয়াতে যাওয়ার পর শেখ হাসিনার ভাষায় যাকে তেঁতুল হুজুর খেতাব দেয়া হয়েছিল, তাঁর পায়ে সালাম করেন তিনি নিজেই। এরপরই হেফাজত-সরকারের সখ্যতার বিষয়টি জনসম্মুখে স্পষ্ট হয়।
হেফাজত নেতাদের সাথে শেখ হাসিনার এ দেখা-সাক্ষাতের অনুষ্ঠানে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে সরকারি স্বীকৃতির ঘোষণা দেয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হেফাজত-সংশ্লিষ্ট অনেক আলেমের দাবী, কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতির বিনিময়ে আওয়ামী লীগের পুতুলে পরিণত হয় হেফাজতে ইসলাম।

কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির শোকরিয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয় ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর। ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এ শোকরিয়া মাহফিলে কওমি মাদ্রাসার বড় একটি অংশ যোগদান থেকে বিরত থাকেন। ওই শোকরিয়া মাহফিলে শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধিও দেওয়া হয় আল্লামা আহমদ শফির উপস্থিতিতে।

কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতির পাশাপাশি সরকারি উপঢৌকন হিসাবে হাটহাজারী মাদরাসার নামে রেলের ৩০ একর জমি এবং আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানীকে নগদ অর্থ প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বিভিন্ন সময় বিবৃতি দিয়েছে হেফাজত।